কক্সবাজার, সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

দেশের বৃহত্তম শুঁটকি মহাল নাজিরারটেক

মাসে ২ হাজার টন শুঁটকি উৎপাদন, ব্যবসা ৩০০ কোটি টাকার

দেশের বৃহত্তম শুঁটকি মহাল কক্সবাজারের নাজিরারটেকে পুরোদমে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবহাওয়া অনূকূল থাকলে এই মহালে প্রতিমাসে উৎপাদিত হয় ২ হাজার টনের বেশি শুঁটকি। যার বাজারমূল্য প্রায় আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ কোটি টাকা। এসব  উৎপাদিত শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় বিদেশেও।
কক্সবাজার শহর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে প্রায় ১২৫ একর একর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে এই মহাল। যেখানে সকালের সূর্য ওঠার সাথে সাথেই শুরু হয় জান্নাত আরা বেগম, অলিভিয়া বা আনোয়ারা বেগমদের কাজের ব্যস্ততা। সাগর থেকে আনা বিভিন্ন প্রজাতির মাছে লবণ মাখানোর পর তারা মাছের পেটের অংশটুকু কাটেন অবিরত। বেলা বাড়ে, কিন্তু তাদের মাছ কাটার কাজ যেন শেষই হয়না। কাটা মাছগুলো পানিতে ধোয়ার পর তোলা হয় চাতালে বা বাঁশের মাচায়। যেখানে প্রকারভেদে রোদে শুকানোর দুই থেকে ১০ দিনের মধ্যে মাছ পরিনত হয় শুঁটকিতে।
নাজিরারটেকের একটি শুঁটকি মহালের মালিক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই মহালে ২০-২৫ প্রজাতির মাছ রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি। এর মধ্যে আছে ছুরি, চাপা, সুরমা, রূপচাঁদা, ফাইসা, লইট্ট্যা, পোয়া, চিংড়ি, লাক্ষা, মাইট্যা, কেচকিসহ নানা প্রজাতির মাছ। ছোট মাছগুলো সরাসরি শুকানো গেলেও বড় মাছ কেটে বাঁশের মাচায় শুকানো হয়।
শ্রমিক ও ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এ শুঁটকি মহালে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক যুক্ত আছে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরির পেশায়। বর্ষাকাল ছাড়া প্রায় ৯ মাস শুঁটকি উৎপাদন হলেও এখন চলছে শুঁটকি উৎপাদনের ভরা মৌসুম। প্রতিটি শুঁটকি মহালে শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ মাছ পরিষ্কার করছেন, কেউ মাচায় তুলছেন। কথা বলারও ফুসরত নেই তাদের। তবে যাদের শ্রমে-ঘামে এই উৎপাদন, সেই শ্রমিকের মজুরি নিয়ে রয়েছে অসন্তোষ।
শ্রমিক আনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা দিনভর কাজ করি। কে্উ মাছ কুটি, কেউ মাছ শুকাাত দিই। কিন্তু আমাদের দুঃখ কখনো ফুরায় না। টানাপোড়েনে সংসার চলে। অথচ এই শুঁটকি মহালে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
নারী শ্রমিক জাান্নাত আরা বেগম বলেন, সকালে সাগর থেকে মাছ আনার পর আমাদের কাজ হলো সেগুলো লবণ মাখিয়ে পেটের আংশ কেটে ফেলা। পেটের বিশেষ অংশটুকু কেটে ফেললে মাছ আর পঁচে না সহজে। পুরুষ শ্রমিকরা ছোট মাছগুলো চাতালে তুলে দেন। আর বড় মাছগুলো তোলা হয় বাঁশের মাচায়। কয়েকদিনের মধ্যেই শুঁটকি বিক্রির উপযোগী হয়।
নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. আতিক উল্লাহ বলেন, প্রতি সপ্তাহে শুধুমাত্র নাজিরারটেক শুঁটকি মহালে মাছের গুঁড়াসহ প্রায় ৫০০ টন বিভিন্ন জাতের শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। আর প্রতিমাসে উৎপাদন হয় ২ হাজার টনের বেশি। যার বাজারমূল্য প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা। উৎপাদিত এসব  শুঁটকি শুধু কক্সবাজারে নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা হচ্ছে বিদেশেও।
তবে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় এই শুঁটকি মহালে ব্যবসায়ীদের অন্তত দেড় কোটি টাকার শুঁটকি নষ্ট হয়েছে দাবী করেছে নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতারা। মো. আতিক উল্লাহ বলেন, বর্তমানে ব্যবসায়ীদের খুবই দুঃসময় যাচ্ছে । সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে ব্যবসায়ীরা আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। আরও বেশি শুঁটকি উৎপাদন করতে পারবে।
কক্সবাজার সদরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তারাপদ চৌহান বলেন, দেশের মানুষের প্রোটিনের বড় একটি অংশ কক্সবাজারে উৎপাদিত শুঁটকি থেকে পূরণ হচ্ছে। শুঁটকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
তিনি বলেন, একসময় কক্সবাজারে শুঁটকি উৎপাদন হতো অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে বালুচরে বা খোলা জায়গায়। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। চাতালে বা বাঁশের মাচায় উৎপাদিত হচ্ছে শুঁটকি। এতে অনেকটা কমেছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পর্যটকরা ভ্রমনে এলে শুঁটকি নিয়ে যাচ্ছেন। মূলত সরকারের সচেতনতামূলক প্রচারণার কারনেই এটি সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করি শুঁটকিকে ‘পর্যটন পণ্য’ হিসেবে ঘোষনা করা উচিত।
শুধু নাজিরারটেক নয়, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়াসহ জেলার উপকূলীয় বিভিন্ন শুঁটকি মহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে।

পাঠকের মতামত: